তালাক || The Devorce ||




    তখন আমি বকুলতলা নামে দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার এক গ্রামে গ্রামীণ ব্যাংকের নতুনহাট ব্রাঞ্চে চাকরি করি। জয়নগর-মজিলপুর স্টেশনে নেমে প্রায় আট দশ কি.মি ভ্যান রিক্সায় যেতে হয়। ওখানেই আনারুলের সাথে আমার পরিচয়। বকুলতলার নতুনহাটে ওর একটা চায়ের দোকান ছিল। আমি যদিও দুপুরের টিফিন খেতাম মাখনের দোকানে এবং মাখনই আমাদের অফিসে চা সাপ্লাই দিত, তবুও দিনে অন্তত দু তিনবার চা খেতে যেতাম আনারুলের দোকানে। উনিশ কুড়ি বছর হবে ছোড়ার। খুব মিষ্টি ছিল ওর কথাবার্তা এবং ব্যবহার। বিয়ে থা করা হয়ে গেলেও একটা শিশুসুলভ আচরণ ছিল ছেলেটার। টুকটুকে ফর্সা গায়ের রঙ, সুন্দর মুখশ্রী, টানা টানা দুটি চোখ, টান টান নাক। আমি ওকে মজা করে বলতাম -- জানিস্ তো আনারুল, তোকে তোর খোদা মেয়ে বানাতে গিয়ে ভুল করে ছেলে গড়ে ফেলেছে।
 
    ও লাজুক হেসে বলত -- ধুরো, কি যে বলেন স্যার ?
হঠাৎ একদিন নতুনহাটে ভ্যান থেকে নেমে দেখি আনারুলের বন্ধ দোকানের সামনে একটা জটলা। এগিয়ে যেতে মাখনের সাথে দেখা। ওকে জিজ্ঞেস করলাম -- কি হয়েছে রে মাখন? আনারুলের দোকান বন্ধ কেন আর এত জটলা কিসের ? আনারুলের কোন বিপদ আপদ হয়েছে না কী ?
মাখন আমাকে তফাতে নিয়ে গিয়ে বলল -- স্যার, আপনার আনারুল সাহেব তো বিবিরে তালাক দিছে।
আমি চমকে উঠলাম -- তালাক দিছে মানে? সবে তো বছর খানেক হল বিয়ে করল। ওইটুকু ছেলে মেয়ে। ভালই তো ছিল দুটিতে। কোন ঝগড়া ঝাঁটিও তো ছিল না। এরই মধ্যে তালাক দিয়েছে মানে?
মাখন বলল -- আর বলেন কেন স্যার? বৌটার ভাই এসেছিল কালকে বোনের সাথে দেখা করতে। ভাইয়ের সাথে গল্পে গল্পে গোস্ততে দুবার লবন দিয়ে ফেলেছে।
 
    আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম -- এই সামান্যতম অপরাধে তালাক ? এত বদরাগী তো বুঝি নি আগে।
মাখন বলে -- আসলে দুপুরে দোকান বন্ধ করে বাড়িতে গিয়ে স্নান করে বেটার খুব খিদে পেয়েছিল। সকালে গোস্ত কিনে বাড়ি পাঠিয়ে বলে দিয়েছিল মা যেন রান্না না করে। বিবির হাতের রান্না খাবার সখ হয়েছিল মিঞাঁ সাহেবের।
আমি বললাম -- তা না হয় হল! কিন্তু এখানে এত জটলা কেন? এদের কি কাজ এখানে?
মাখন হেসে বলল -- বুঝলেন না স্যার? সঙ দেখতে এসেছে সব। মুখরোচক গপ্পো পেয়েছে সব। এর মধ্যে কয়েকগাছা হারামীও আছে যাদের জিভে লালা ঝরছে। সুন্দরী কচি মেয়ের গন্ধ পেয়েছে না !
এই হচ্ছে গ্রামীণ সমাজের একটা বৈশিষ্ঠ্য -- দূর দূরান্তের গ্রামে কোন একটা ঘটনা ঘটলে সেটা চলে আসে সোজা হাটে। কেউ কেউ আহা উহু করে বলে -- ছেলেটার মাথায় কি যে ভূত চাপল কে জানে! এই সামান্য অপরাধে কেউ তালাক দেয় ?
 
    কারো গলায় আবার আক্ষেপের সুর -- আহা রে! ঐটুকু মেয়ে !
কোন কোন বিজ্ঞ আবার মেয়েটার চরিত্রের প্রতি সন্দেহ করতেও ছাড়ে না -- ভিতরে খোঁজখবর নিয়ে দেখো গিয়ে, হয় তো তলে তলে মেয়েটার অন্য কোন নাজায়েস সম্পর্ক ছিল কারো সাথে!
মাখন বলল -- কিছুই হ'ত না স্যার। রাগের মাথায় তিন তালাক বলে ফেলেছে। বাড়ির অন্দরের কথা অন্দরেই থাকত। কিন্তু মুশকিল হল ওদের বাড়িতে তখন এক কুটনি বুড়ি ছিল ; ওর মায়ের সাথে গল্প করছিল। সেই বদমাইস মহিলাই সারা গ্রামে রাষ্ট্র করে দেয় কথাটা। কাল বিকেলেই ওদের নিয়ে সালিশী বসে এবং তালাক বহাল রাখে মুরুব্বিরা।
আমি জিজ্ঞেস করলাম -- ওর বউ এখন কোথায় ?
মাখন বলল -- কাল রাতেই তাকে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।
আমি টিটকিরি করে বললাম -- বাব্বা, তোদের গ্রামের সালিশীসভা তো ভীষণ স্ট্রিক্ট! হাইকোর্টের জাজমেন্টও তো এত তাড়াতাড়ি লাগু হয় না।
 
মাখন বলল -- বললাম না সব পাজীর পাঝাড়া। আনারুল কেঁদে কেটে মুরুব্বিদের পায়েও ধরেছিল। কিন্তু তারা সিদ্ধান্তে অনড়। আপনার ভ্যানওয়ালা নজিম রেগেমেগে আনারুলকে বলেছিল -- তুই বিবিকে ছাড়বি না। মানবি না সালিশীর বিচার। ব্যস্ ফরমান জারি হল বিবিকে পরিত্যাগ না করলে মসজিদে যাওয়া বন্ধ আনারুলের, নামাজ আদায় বন্ধ, রোজা রাখা বন্ধ, গ্রামে একঘরে করে দেওয়া হবে আনারুলের পরিবারকে।অগত্যা আনারুলের মাকে সালিশী সভার বিধান মেনে নিতে হয়। আপনি কল্পনা করতে পারবেন না স্যার -- রাতে যখন মেয়েটার ভাই আর বাপজান ফিরিয়ে নিয়ে যায় সে কী কান্না দুটোর।
মনটা খুব ভারী হয়ে গেল। ধীর পদে চলে গেলাম অফিসে।
সাত আটদিন পরে আনারুলের দোকান খুলল। এই ক'দিনেই ছোড়া চোখমুখের ছিরি যা করেছে তাতে বোঝাই যায় মরমে মরে আছে ও। তালাক দেওয়া বিবিটাকে কিছুতেই ভুলতে পারছে না। শরীরটা ভেঙে গেছে ; সেই ঔজ্জ্বল্য যেন কোথায় হারিয়ে গেছে। আগের সেই সদাহাস্যময় মুখ আর নেই ; অত ফর্সা সুশ্রী মুখের উপর কে যেন এক দোয়াত কালি ঢেলে দিয়েছে। একটু বদমেজাজি হয়েও গেছে। মাঝেমধ্যেই কাষ্টমারদের সাথে বাতবিতন্ডায় জড়িয়ে পড়ে চায়ে চিনি কম বা বেশী নিয়ে। কিছু কাষ্টমারও তেমনি সরেস। ওকে খোঁচা মারার জন্যই ওর তালাকের কথা তোলে ; কেউ কেউ আবার সহানুভূতি দেখানোর চেষ্টা করে। কেউ কেউ বা আবার ওকে সদুপদেশ দেয় -- ছাড় তো আগের কথা। এবার আবার একটা সাদী করে নে -- তাহলেই দেখবি সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। 
 
প্রচন্ড বিরক্ত হয় আনারুল এই সব কথাতে -- এটা বুঝেও ইচ্ছাকৃত ভাবেই এই সব কথাবার্তাগুলি বলে ওর পেছনে লাগার জন্য। অদ্ভুত এক ধরণের আনন্দ উপভোগ করে লোকগুলি। মাঝেমধ্যেই ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে আনারুল। রেগে গিয়ে বলে -- এছাড়া আর কোন কথা নেই তোমাদের? যদি না থাকে তো বেরোও আমার দোকান থেকে। আর কক্ষণো আসবে নি। আমি তোমাদের চা বেঁচবো নি যাও।
আমি কখনও বা ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বা কখনও বা ওর ঘাড়ে হাত দিয়ে আলতো চাপ দিয়ে ওকে ঠান্ডা করি। পাশের দোকানি মাখনও ঐ বদ লোকগুলিকে বলে -- তোমাদের কী বাপু আর কোন কাজ নেই গো? বেচারা মরমে মরে আছে ; তার উপর খোঁচা দিয়ে চলেছ অনবরত! মজা পাচ্ছ খুব তাই না ? ভারী অসভ্য লোক তোমরা।
বছর খানেক কেটে গেল। আনারুল কোনদিন দোকান খোলে, কোনদিন আবার খোলে না। ইচ্ছে না করল তো পরপর চার পাঁচদিনও একটানা দোকান খুলল না। না, বিয়ে থা আর করে নি। ওর মা ছেলের মতিগতি দেখে দু তিনটে মেয়ে দেখেছিল। কিন্তু ছেলে রেগে বলেছিল -- আম্মি, তুই যদি আবার সাদীর কথা বলিস্ তো তোকে আমি খুন করে ফেলব।
 
    মা ও আর ও পথে পা বাড়ায় নি। ছেলের উপরেই ছেড়ে দিয়েছিল। ছেলে যেদিন নিজে থেকে রাজী হবে সেদিনই আবার ছেলের বৌ আনার কথা ভাববে। ছেলেও হাত পা গুটিয়ে বসে ছিল না, আমার ভ্যানওয়ালা নজিম ও আরো দু একজন বন্ধুর সাথে আলোচনা করতে লাগল কিভাবে আবার পুরানো বিবিকেই নিকাহ করা যায়! মুসলিম কাষ্টম অনুযায়ী তালাক দেওয়া বিবি যদি আবার কাউকে বিয়ে করে তালাক পায় তাহলেই তালাক দেওয়া বিবিকে আবার বিয়ে করে ঘরে তোলা যায়। বন্ধুরা সেই পরামর্শ দিল। কিন্তু যদি মেয়েটাকে আর কারো সাথে বিয়ে দেওয়া হয় এবং সে যদি বিবিকে তালাক দিতে না চায় তো তাহলে মহা মুশিবত। জোর করে তালাক দেওয়ানো তো যাবে না। ওদিকে তালাক প্রাপ্তা বিবিও অস্থির হয়ে উঠেছে পুরানো মিঞাঁর ঘরে ফেরার জন্য। কেঁদেকেটে নিজের আব্বুজানের বুক ভিজিয়ে ছাড়ছে। কিন্তু আব্বুজানেরও সেই এক ভয়, মেয়ের বিয়ে না হয় দিলেন কিন্তু নূতন দামাদ যদি তালাক না দেয় তাহলে তো মেয়েটা আত্মঘাতিনী হবে। অনেক ভেবেচিন্তে নজিম ঠিক করল এক চুয়াত্তর বছরের বুড়োর সাথে আনারুলের তালাক দেওয়া বিবিকে নিকা করাবে। এই বুড়ো পাশের গাঁয়েই থাকে এবং আনারুলের মায়ের দূরসম্পর্কের মামা। কথা ছিল নিকার পরের দিনই বুড়ো তার নতুন বিবিকে তালাক দেবে এবং তারপরে একটা দিন দেখে আনারুলের সাথে তার তালাক দেওয়া বিবির আবার নিকা হবে। কিন্তু আনারুলরা যা আশঙ্কা করেছিল তাই হল -- বুড়ো আর নতুন কচি ডাগর বিবিকে তালাক দিতে চায় না কিছুতেই। নজিমরা বুড়োকে ভয় দেখাতে গেলে বুড়ো উল্টে ওদের সালিশীর ভয় দেখায়, মৌলবী সাহেবের ভয় দেখায়। আনারুলের মা ও একদিন তার মামাকে অনুরোধ করল বিবিকে তালাক দেবার জন্য। তাতে বুড়ো গেল আরও চটে। রেগেমেগে বললেন -- আমার বিবিরে তালাক দিব কী না সেটা আমার বিষয়। তুই ছেড়ী এটা নিয়ে কথা বলিস্ কেন ?আমার বিবি আমি তালাক দিব না -- আমার সাফ কথা শুনে রাখ।
এইভাবে মাস খানেক কেটে গেল। বুড়ো আর তালাক দেবার নাম গন্ধও করে না। নজিমরা অতি গোপনে খবরও নিয়েছে বুড়োর প্রথম বিবির কাছে যে নতুন বিবির সাথে বুড়ো রাতও কাটায় না। বুড়ো আলাদা ঘরে শোয় আর নতুন বিবি বড়বিবির সাথে বড়বিবির ঘরেই ঘুমোয়। নজিম জয়নগর স্টেশন থেকে আমাকে বকুলতলায় নিয়ে আসার সময় বলল -- স্যার, আপনি কষ্ট করে আমার সাথে বুড়োর বাড়িতে একদিন যাবেন? আপনি বললে হয় তো বুড়ো কথাটা ফেলবে না ; তালাক দিতে রাজী হয়ে যাবে। প্রধান সাহেবও যাবেন আমাদের সাথে। চলেন না স্যার একটিবার। বেচারা আনারুলের কষ্ট তো আর দেখা যায় না।
প্রধান সাহেব মুসলিম। উনি সঙ্গে থাকবেন শোনাতে আমি নিমরাজী হলাম। যদিও আমি নিশ্চিত ছিলাম যে কোন কাজ হবে না। এই জাতীয় বুড়ো গুলি হয় অদ্ভুত রকমের ধর্মভীরু -- কোন যথোপযুক্ত কারণ ছাড়া বিবিকে তালাক দেবেন না। আর তা না হলে চূড়ান্ত রকমের পারভার্ট হয় -- কোন মতেই কচি ডাগর সুন্দরী বিবিকে ছাড়বেন না।
 
    পরের শণিবার আমি বেলা দুটো নাগাদ আমার অফিস থেকে বেরিয়ে প্রধান সাহেবকে সঙ্গে নিয়ে নজিমের ভ্যানেই পাশের গ্রামে বুড়োর বাড়িতে গেলাম। বুড়োর ভদ্রতা বা সৌজন্যবোধের কোন তুলনা নেই। আমাদের দেখেই চিৎকার করে উঠলেন -- হায় খোদা কি নসীব আমার? প্রধান সাহেব আর ম্যানিজার সাহেব একসাথে আজ আমার মঞ্জিলে! ও নতুন বিবিজান, বড় বিবিজান কোথায় গেলে তোমরা ? এদিকে এসো, দেখ মেহেমান এসেছে যে।
একজন ভারী শরীরের বয়স্কা ভদ্রমহিলা ও ছিপছিপে শরীরের একদম অল্প বয়সী মেয়ে এসে দাঁড়াল বৈঠকখানার দরজার পাশে। নজিম বুড়োকে পা ধরে সালাম করে বয়স্কা মহিলাকেও সালাম করে জিজ্ঞেস করল -- কেমন আছেন নানী?
নানী হেসে উত্তর দিলেন -- ভাল আছিরে নাতি।
নজিম এবার অল্প বয়স্কা মহিলার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল -- তুই কেমন আছিস্ নাজনীন?
বুঝলাম, ঐ অল্পবয়সী মেয়েটিই আনারুলের তালাক দেওয়া বিবি। নামও আজই জানলাম -- নাজনীন।
নাজনীন ম্লান হেসে জবাব দিল -- আছি একরকম। তুমি কেমন আছ নাজিম ভাইয়া।
বুড়ো বলে -- ভাইয়া কি গো বিবিজান ? ও তো তোমার নাতি হয় সম্পর্কে।
তারপর নজিমের দিকে তাকিয়ে খেঁকিয়ে ওঠে বুড়ো -- তুই আবার হেথায় এয়েছিস্ ? তোকে না সেদিন মানা করলাম আমার বাড়ির ত্রিসীমানায় আসবি না!
প্রধান সাহেব শশব্যস্ত হয়ে বললেন -- না না ও নিজে থেকে আসে নি। আমরাই ওর ভ্যানে করে এসেছি। আপনি রাগ করবেন না।
বুড়ো বলে -- ভ্যানওয়ালা তো ভ্যানে বসে থাকুক গে, অন্দরমহলে আইছে ক্যান। যা ছোড়া বাড়ির বাইরে গিয়ে ভ্যানে বসে থাক্ গে।
প্রধান চোখের ইশারায় নজিমকে বাইরে যেতে বলে। নজিম বাইরে বেরিয়ে গেলে বুড়োর দুই বিবিও বাড়ির অন্দরমহলে চলে যায়। বুড়ো আয়েস করে বসে বলল -- তা বলেন প্রধানসাহেব, ম্যানিজার সাহেব কি হেতু এই ফকিরের কুটিরে আসা।
 
    প্রধান সাহেব ও আমি সব কিছুই খুলে বললাম। যদিও বুড়ো যে ধরণের ব্যবহার করল নজিমের সাথে তাতে ন্যূনতম আশা ছিল না যে বুড়ো আদৌ নতুন বিবিকে তালাক দিতে রাজী হবে।
সব শুনে বুড়ো বলল -- শোনেন প্রধান সাহেব, আপনি বোধ হয় জানেন না ঐ আনারুল ছোড়া আমার নাতি হয়। ওর মায়ের দূর সম্পক্কের মামা আমি। আমি নাজনীনরে নিকা করেছি বটে, কিন্তু ওর হাতও ছুঁয়ে দেখি নাই। সেই দিন থ্যিকা ও বড় বিবির সাথেই শোয়। ও আনারুলের আমানত আমার কাছে গচ্ছিত আছে। আনারুলের হাতেই ওরে তুইলা দেব। তার আগে ঐ শুয়ার আনারুলটারে ভাল মত শিক্ষা দেব। ঐটুকু ছাওয়াল, অত তেজ কিসের? গোস্ততে নিমক বেশী হইছে বইলা একেবারে তিন তালাক দিয়া দিল। মাইয়াগুলান কী গাঙের পানিতে ভাইসা আইছে। তুচ্ছাতিতুচ্ছ কারণে তালাক দিবি। মনের জ্বালায় মরুক হারামীর পো আরো কতকদিন। তার পরে আমি নাজনীনরে তালাক দিয়া ওর হাতে তুইলা দেব।
আমি এতদিন ধরে ভদ্রলোককে খুব বদলোক ভেবেছিলাম। কিন্তু এখন যা শুনলাম ওনার মুখে আমি হতবাকই হয়ে গেলাম। কিছুক্ষণ আগেও যাকে পারভার্ট ভেবেছিলাম এখন তার উপর শ্রদ্ধায় মাথাটা নত হয়ে আসছিল। আমি মুখ নীচু করে বসেছিলাম। বুড়ো আমার উদ্দেশ্যে বলল -- ম্যানিজার বাবু তো আমায় বদলোক ভেবে বসে আছেন, তাই না? না গো ম্যানিজার সাহেব, আমি অতটা বদ না। আমারও তো তিন তিনটে মেয়ের সাদী দিতে হইছে। আর আপনাগো শুভ কামনায় আমার বুড়ি বিবিরে লয়ে মহাসুখেই আছি আমি। আনারুলের মায়ের সাথে আমার কথা হইছে। মাসখানেক আরো থাকুক নাতবৌ এইখানে। নানীর কাছে রান্নাবান্না ঘরের কাজকাম শিখুক কয়টা দিন। তারপরে আপনাগো দাওয়াত দিয়ে এক জুম্মাবার দেইখা আমার সাধের ছোট বিবিরে নাতির হাতে তুইলা দেব খন।
 
    প্রধান সাহেব বিগলিত হয়ে বলেন -- সত্যিই চাচা আপনি একজন লোক বটে! এমন নাটক করলেন দুই মাস ধরে যেন আপনি কিছুতেই নাজনীনরে ছাড়বেন না।
বুড়ো হা হা করে হেসে বলে -- ওরে ভাই কচি ডাগর নাতবৌরে কী আর ছাড়তে ইচ্ছা করে রে? কিন্তু কি করব? নাতি হারামিটা যা পাগল হইছে কবে না আমায় খুন করে আর না হলে নিজে ফলিডল খায়।
হাসতে হাসতে হাপিয়ে ওঠে বুড়ো। অনেক কষ্টে বড় বিবিকে বলে খাওয়ার পানি দিতে। বড় বিবি একটা ঘটিতে জল এনে দেয় বুড়োর হাতে। পরম মমতায় আঁচল দিয়ে বুড়োর ঘেমে যাওয়া কপালটা মুছে দেয়। বুড়ো একটু আত্মস্ত হয়ে আবার ফাজলামি শুরু করল -- ও ম্যানিজার দেখেছ বড়বিবি কত খেয়াল রাখে আমার! আমার আর কোন বিবির দরকার আছে না কী ?
বড়বিবি লজ্জায় মাথার কাপড়টায় মুখ আড়াল করে চলে গেল বাড়ির ভিতরে। বুড়ো এবার সিরিয়াস হয়ে প্রধানকে বলল -- শোন গো প্রধান সাহেব, এখনই আনারুল বা ঐ নজিম বেটাচ্ছেলেদের কিছু কওনের দরকার নাই। আমার নাতি হারামজাদা আরেকটু জ্বলুক। তালাক দিলে মাইয়ার বাপের বুকে কতটা পোড়ে একটু বুঝুক। ওর মায়ে সব জানে। সে কিছুই কইব না ছাওয়ালরে। তোমরাও বলবা আমি রাজী হই নাই তালাক দিতে। তবে খেয়াল রাইখো আকাম যেন না কইরা বসে পাগলটায়!
আমরা বেরিয়ে এলাম বুড়োর বাড়ি থেকে। নজিম জিজ্ঞেস করল -- বুড়ো কি বলল? কবে দিব তালাক?
প্রধান বিরক্তির ভাব দেখিয়ে বলল -- বজ্জাত বুড়ো তালাক দেবে বলে তো মনে হয় না।
নজিম মুখটা শুকনো করে ভ্যান চালাতে চালাতে বলে -- ঐভাবে হবে না। শালার বুইড়ারে আড়ং ধোলাই দিতে হবে।
আমি ওকে ধমকে বললাম -- একদম ওস্তাদি করবি না। আমরা তো কথা বলেছি। দেখি না কি হয় !
-- দেখেন! -- বলে চুপচাপ ভ্যান চালাতে থাকে নজিম।
পরের দিন থেকে উৎপাত শুরু হল আনারুলের -- ও স্যার, আপনারা যে গেলেন বুড়োর কাছে -- কিছু সুরাহা হল? কি বলে বুড়ো ? কবে তালাক দিব ?
ওর অস্থিরতা দেখে আমার খুবই খারাপ লাগছিল। বেচারা সত্যিই বিবিটাকে বড্ড বেশীই ভালবাসে। অন্যের বিবি হয়ে পড়ে রয়েছে এটা সহ্য করতেই পারছে না মন থেকে । বিবিকে ফিরে পাবার জন্য পাগল হয়ে উঠেছে। তবু বুড়োর পরিকল্পনা মত ওকে কঠিন গলায় বললাম -- দাঁড়া, সবে তো একদিন গেলাম। বুড়ো একটু ঠ্যাঁটা আছে ; অত সহজে কাজ হবে না। তোকে অপেক্ষা করতেই হবে যতদিন না বুড়ো নিজে থেকে তালাক দেয়।
অসহিষ্ণু হয়ে আনারুল বলে -- আর কবে দেবে তালাক ? বছর তো ঘুরতে চলল!
আমি এবার রাগত স্বরে ওকে বললাম -- অতই যখন দরদ তো ফালতু কারণে তালাক দিয়েছিলি কেন ? তোদের ধর্মের রীতি নীতি জানিস্ না? এখন তালাক দেওয়া বিবির জন্য পাগল হয়ে উঠেছিস্! এখন ও আর তোর বিবি নয়, অন্য একজনের বিবি। সহি সালামৎই আছে। এখন বুড়ো যদি কখনো তালাক দেয় তাহলেই তাকে ফিরে পাবি। ঘ্যান ঘ্যান করে আমার মেজাজ খারাপ করবি না আনারুল।
আমার ধমক খেয়ে কেমন যেন চুপসে গেল ছেলেটা। নিঃশব্দে আমায় চা দিয়ে চুপচাপ বসে রইল ওর বসার জায়গায়। মুখটা শুকিয়ে আমসি হয়ে গেছে ওর। চা শেষ করে বেরিয়ে এলাম দোকান থেকে। ওর ঐ কাতর মুখটা যাতে দেখতে না হয় তাই ওর দোকানে যাওয়াও কমিয়ে দিলাম। কিন্তু নজিম মারফত ওর সব খবরই রাখতাম। একদিন এমনও শুনলাম নজিমের মুখে যে আনারুল বিবিকে ফিরে পাবার আশাই ছেড়ে দিয়েছে।
সপ্তাহ দুয়েক পরে একদিন দুপুর একটা নাগাদ প্রধান সাহেব পাজামা আর কচি কলাপাতা রঙের একটা পাঞ্জাবী পরে ফুলবাবু সেজে আমার অফিসে এলেন। চা খেয়েই ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। আমার হাত ধরে টানাটানি শুরু করলেন -- আরে ওঠেন ওঠেন ম্যানজারবাবু, নাজনীনের বাপের বাড়িতে যেত হবে এক্ষুনি।
আমি দুশ্চিন্তায় পড়লাম -- হঠাৎ নাজনীনদের বাড়িতে যেতে হবে কেন? জিজ্ঞেস করলাম -- হঠাৎ নাজনীনের বাপের বাড়িতে কেন? কি হল আবার ওখানে ? আর তাছাড়া ক্যাশ না উঠলে যাব কি করে?
প্রধান নাছোড়বান্দা -- না না ক্যাশ তুলে বেরোতে গেলে অনেক দেরী হয়ে যাবে। ক্যাশ ওরা সবাই মিলে তুলে নেবে। আপনি এক্ষুনি চলেন । একরকম হির হির করে টেনে ব্রাঞ্চের বাইরে এনে ভ্যানে তুলনেন। না নজিমের ভ্যান নয়, অন্য একটি ছেলের ভ্যানে। বকুলতলার শেষ মাথায় বাইশহাটা গ্রামে নাজনীনের বাপের বাড়ি। পাকা বাড়ি নয়, এমনিই সাদামাটা বেড়া ঘেরা কাঁচা বাড়ি টিনের ছাউনি দেওয়া। বাড়ির সামনে উঠোনে সামিয়ানা টাঙানো। লোক সমাগমও হয়েছে খারাপ না। ভ্যান থেকে নেমে আমি প্রধান সাহেবকে জিজ্ঞেস করলাম -- কি ব্যাপার বলুন তো প্রধান সাহেব? এখানে এলেন কেন ?
প্রধান সাহেব আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে চললেন -- আরে আগে ভিতরে চলুন না। আপনার আনারুলের আজ নিকা।
আমি হেসে বললাম -- তা পাত্রীটা কে? আগের বিবিই তো? না কী তার বোন?
প্রধান বললেন -- আরে না রে বাবা, নাজনীনের সাথেই । ঐ পাগল নাজনীনরে ছাড়া আর কাউরে নিকা করবে না কী?
আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললাম -- যাক্ বাবা, শেষপর্যন্ত তাহলে বুড়ো ডাগর বিবিকে তালাক দিল !
প্রধান হেসে বলল -- আরে দাদা তালাক কি বলছেন? আজকের এই নিকার বরকর্তা কনেকর্তা সবই তো ঐ বুড়ো। লোক খাওয়ানোর খরচাপাতিও তার। এমন কী কাজীও ডেকে এনেছে ঐ বুড়োই।
আমি হেসে বললাম -- বলেন কি প্রধানসাহেব। বুড়ো তো দেখছি সত্যিই ভাল লোক! খামোকা নজিমের কাছে শুনে মানুষটাকে আমি খুব খারাপই ভেবেছিলাম।
কথা বলতে বলতে আমরা নাজনীনদের উঠোনে এসে হাজির হলাম। দেখি বিয়ের মজলিজে মাথায় টুপি ও মালার ঝালরে মাথা আচ্ছাদিত করে বর কণে বসে আসে কাজী সাহেব ও অন্যান্য মুরুব্বিদের সামনে। আনারুল ওদের প্রথা অনুযায়ী সাদা রুমালে মুখ চাপা দিয়ে বসে আছে। নাজনীন বাচ্চা মেয়ের মত মুখ নীচু করে গুটিসুটি মেরে বসে আছে। ওকে মায়ের মত ধরে বসে আছেন বুড়োর বড়বিবি।
বুড়ো বিয়ের মন্ডপে মধ্যমণি হয়ে একটা চেয়ারে বসে সব তদারকি করছেন। পরিপাটি হয়ে সেজেগুজে এসেছেন। চোখে সুরমা লাগিয়েছেন, হাতে একটা বাহারি ছড়ি। সারা গায়ে ভুরভুর করছে আতরের গন্ধ। নজিমকেও দেখলাম মাঞ্জা মেরে সব অতিথি অভ্যাগতদের শরবত সার্ভ করে যাচ্ছে হাসি মুখে। বুড়ো শশব্যস্ত হয়ে উঠলেন আমায় আর প্রধানকে দেখে। বুড়ো চীৎকার করে উঠলেন -- ওরে এখানে দুটো চেয়ার দে রে। আসেন আসেন ম্যানিজার সাহেব আমার দুপাশে বসেন আপনি আর প্রধানসাহেব। আমি তো কনেপক্ষ, আপনারাই তো হলেন গিয়ে পাত্রপক্ষ। আমরা ওনার পাশে বসলাম।
কবুলতনামা পাঠ করানো হল মিঞাঁ বিবিকে দিয়ে। বিশ লক্ষ টাকা দেনমোহর শুনে তো আমার ভিরমি খাবার জোগাড়। বুড়োকে চুপি চুপি জিজ্ঞেস করলাম -- ও চাচা, এত টাকা দেনমোহর দেবে কোত্থেকে আনারুল ? সব সম্পত্তি সমেত নিজেকে বিক্রী করলেও তো পাঁচলাখ টাকাও জোগাড় করতে পারবে না। ভবিষ্যতে যদি আবার তালাক দেয় তো কোথায় পাবে এত টাকা ?
বুড়ো হেসে বলে -- হারামির পো আর যাতে তালাক দিতে না পারে তার জন্যই তো এই ব্যবস্থা। তরকারিতে নিমক বেশী হয়েছে বলে তালাক দিবি ? দে বেটা এবার তালাক দে! বিশ লাখ টাকা ফ্যাল্ তারপরে তালাক দে হারামজাদা।
আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম বুড়োর দিকে। ওদের সাদীটাকে টিকিয়ে রাখার জন্য কি অদ্ভূত ফন্দি বের করেছে! ও দিকে বিয়ের সব রসম শেষ। মেয়ের বাড়িতে দু ওয়াক্ত নামাজও সেরে নিল আনারুল ও নাজনীন।এবার মিঞাঁ বিবির মিঞাঁর বাড়িতে ওঠার পালা। ওখানে গিয়ে দুজনের বাসরের আয়োজন। মনে মনে হাসিও পাচ্ছিল আমার -- একই বিবির সাথে দু দুবার বাসরশয্যা! ক'জন ভাগ্যবানের কপালে জোটে। নজিম তড়িঘড়ি করে ওর ভ্যানটাকে সামনে নিয়ে এল মিঞাঁ বিবিকে নিয়ে যাবার জন্য। ভ্যানটাকে দারুণ সাজিয়েছে ব্যাটা আজ রঙীণ কাগজ আর গাঁদা ফুলের মালা দিয়ে। পাটাতনে ভাল রঙচঙে পাটি বিছিয়ে দিয়েছে, দুটো পাশ বালিশও আছে। একেবারে এলাহি ব্যাপার !
বয়স্কদের সালাম জানিয়ে আনারুল মহানন্দে ভ্যানে উঠতে যাবে এমন সময় বুড়ো ছড়ির মাথাটা দিয়ে আনারুলের শেরোয়ানীর কলারটা টেনে ধরে বলে -- ওরে হারামীর পো, ড্যাং ড্যাং করে বিবির পাশে গিয়ে বসছিস্ যে বড়। আগে বলে যা আমায় -- আর কখনো তালাক দিবি বিবিরে?
আনারুল একটা হাতে মুখে চাপা দিয়ে বলে -- তওবা! তওবা!!
 
 
 প্রশান্ত পাইন
দমদম
২৫/০২/২০২২

Comments

Popular posts from this blog

A New Beginning

Internship for Microbiology?

10 Best Microbiology Research Projects for College Students