নিবেদিতার সংসার

 নিবেদিতার সংসার

 


দ্বিতীয়  পর্ব

প্রশান্ত পাইন

        সন্ধ‍্যেবেলায় কলেজ থেকে বাড়ি ফেরে দিবাকর এবং ওর মিসেস স্নিগ্ধা। একই কলেজে অধ‍্যাপনা করে দুজন। চাকরির সূত্রেই দুজনের পরিচয় প্রণয় এবং বছর খানেক হল পরিণয়। আপাতদৃষ্টিতে খুবই ভদ্র নম্র স্বভাবের মেয়ে স্নিগ্ধা। সকালে দেবাদেবী দুজনে একসাথেই কলেজ অভিমুখে রওনা দেয় নতুন কেনা সুইফট ডেজায়ারে। গাড়ি ড্রাইভ করে দিবাকর নিজেই। এই নিয়ে বাপ বেটায় মাঝেমধ‍্যেই যুদ্ধ লাগে। কমলেশের একদমই মত নেই যে দিবাকর নিজে ড্রাইভ করে ; অনেকবারই ছেলেকে বলেছে একটা ড্রাইভার রাখতে। কিন্তু দিবাকর মোটেও রাজী নয়। কেন না গাড়ি চালানোটা ওর একটা অদ্ভুত ধরণের প‍্যাসন। তাই বারবারই কমলেশকে জানিয়েছে যে ড্রাইভাররা তো এমনিতেই তেল মারবে, তার উপর ওদের কলেজে ড্রপ করে সারাদিন খেপ খেটে বেড়িয়ে আবার বিকেলে ওদের পিক আপ করবে কলেজ থেকে। আরও সমস‍্যার ব‍্যাপার যেদিন খুশী ছুটি নেবে। স্নিগ্ধাও ড্রাইভার রাখার পক্ষপাতী নয় ; প্রথমত, ওদের প্রাইভেসী বিঘ্নিত হবে ড্রাইভারের উপস্থিতিতে, দ্বিতীয়ত সামনের সীটে সীটবেল্ট লাগিয়ে ড্রাইভার দিবাকরের পাশে বসে যাওয়া আসার রোমাঞ্চটা ও ছাড়তে রাজী নয় এবং তৃতীয়ত প্রতি উইকএন্ডেই মোটামুটি লং ড্রাইভে বেড়িয়ে পড়ার ব‍্যাপারটাই মাঠে মারা যাবে ড্রাইভার সাহেবের সাপ্তাহিক ছুটির কল‍্যাণে। বাবাকে বোঝানোর জন‍্য দিবাকর অর্থনৈতিক ব‍্যাপারটাকেই সামনে  আনে -- বাবা, ইকনোমিক দিকটাও ভেবে দেখ একবার। একটা ড্রাইভার রাখতে গেলে মিনিমাম বারো তের হাজার টাকা মাইনে গুনতে হবে। তার উপর তেল চুরি করে ফাঁক করে দেবে। প্রতি মাসে একস্ট্রা তিন চার হাজার তেল ভরতে হবে। সর্বসাকূল‍্যে মাসে পনের ষোল হাজার টাকার বার্ডেন। মানে বছরে প্রায় দু লাখ টাকা। কি দাঁড়াল তাহলে ব‍্যাপারটা? তিন চার বছরের মধ‍্যেই এই গাড়িটা বিক্রী করে আরেকটু হাই স্ট‍্যাটাসের গাড়ি কেনা যাবে।

        প্রফেসর ছেলের বৈষয়িক চিন্তা ভাবনা দেখে হতবাকই হয় কমলেশ। নিজে ব‍্যাংকের অফিসারি করেও কোনদিনই বৈষয়িক বিষয়ে চিন্তাভাবনা করে নি। মাসে ভাল স‍্যালারি পেয়েও একটি রেকারিং ডিপোজিটও করে নি সে। দুহাতে দেদার পয়সা উড়িয়ে গেছে আজীবন। রিটায়ারমেন্টের পরও হাজার পঞ্চাশেক টাকা পেনসন আর মান্থলি ইন্টারেষ্ট স্কীমের উপর মাসিক ষোল হাজার টাকা ইন্টারেষ্টের টাকা দিয়ে সংসার ভাল মতই চলে যায় কোন বিলাসীতা বর্জন না করেই। ছেলে বা বৌমার কাছ থেকে সেই অর্থে কোন টাকাই নেয় না সংসার চালানোর জন‍্য। ছেলে স্বতঃপ্রণোদিত ভাবেই ইলেকট্রিক বিলের আট নয় হাজার টাকা এবং প্রত‍্যেক মাসেই শপিংমল থেকে হাজার হাজার টাকার হাবিজাবি যা খুশি মালপত্র কিনে এনে কিচেনের ওয়ারড্রব আর 270 লিটারের ফ্রীজ বোঝাই করবে আর মায়েপুতে বিশ্বযুদ্ধ লাগাবে। এটা মান্থলি ড্রামা কমলেশের পরিবারের।

         ছেলের বৈষয়িক ভাষণ শুনে কমলেশ বিদ্রুপের সুরেই বলে -- বাব্বা! নিবু তোমার ছেলে তো মানুষ হয়ে গেছে! ব‍্যাংকার হয়েও তো আমি কোনদিনই হিসেবী হতে পারলাম না গো!

         দিবাকর বলে -- তুমি হিসেবী হলে তো এতদিনে তোমার তিনটে ফ্ল‍্যাট এবং নিদেনপক্ষে দুটো মার্সিডিজ থাকত।

         কমলেশ বিরক্ত হয়ে বলে -- আমার আর কাজ নেই হিসেবী হয়ে। ব‍্যাংকার ছিলাম তো তাই সারা জীবন টাকা আমার পিছনে ছুটত, আমার প্রয়োজন হয় নি টাকার পিছনে ছোটার। আর তুই যা বলছিস সেটাকে হিসেবী হওয়া বলে না, বলে সখ চরিতার্থতার লোভ। আরো বিলাসিতার হাতছানি। আরো দামী গাড়ি চড়ার বাসনা। নিজের বাসনা চরিতার্থতার জন‍্য বাপমায়ের দুশ্চিন্তার কোন মূল‍্যই নেই তোর কাছে। একবারও ভেবে দেখেছিস যে তুই গাড়ি নিয়ে বেরোনোর পর থেকে আমি বা তোর মা কী দুশ্চিন্তায় কাটাই ? কোন অ‍্যাকসিডেন্ট বা বিপদ আপদ হল কী না! ঠিক মত নিরুপদ্রবে কলেজে পৌঁছালি কী না -- কতরকমের দুশ্চিন্তা হয় আমাদের সেটা একবারও ফিল করেছিস্ ? এত টাকার পিছনে ছুটিস্ না রে বাবা।

         দিবাকর বোঝে বাপের দুশ্চিন্তার ব‍্যাপারটা, কিন্তু মানতে পারে না। ওর মনে হয় সবাই যদি অ‍্যাকসিডেন্টের কথাই ভাবে তাহলে তো আর কেউ ড্রাইভিং শিখবেও না ড্রাইভারিও করবে না।

                        যাই হোক! সেদিন সন্ধ‍্যায় কলেজ থেকে ফিরে দিবাকর লক্ষ‍্য করল যে মা খাটে বসে ভাবলেশহীনভাবে শুয়ে থাকা বাবার সাথে কথা বলছে। খুব অবাক হয় দিবাকর -- এরকম তো হবার কথা নয়। এই সময়টা হল মায়ের দূরদর্শন দর্শণের প্রাইম টাইম। সন্ধ‍্যা ছ'টা থেকে রাত সাড়ে আটটা পর্যন্ত টিভির সামনে থেকে উঠবেই না। বাবাও যথারীতি রাস্তায় চায়ের ঠেকে। ঠিক রাত ন'টায় বাড়ি ফেরার কথা। কিন্তু আজ কি হল যে টিভিও বন্ধ, দুজনেই খাটে ঘর অন্ধকার করে বসে আছে! দিবাকরের মনে পড়ে, 'দিন ধরেই বাবার শরীরটা খুব জুতের নয় ; খিদে নেই, আগের মত কর্মচঞ্চলও নয়। চায়ের আড্ডার সময়ও কমে গেছে অনেক। কেমন যেন একরকম জোর করেই ঠেলে নিয়ে চলছে শরীরটাকে। ডাক্তার একগাদা ব্লাড টেষ্ট করতে বলেছিল। আজ সকালেই তো রিপোর্ট গুলো আসার কথা !

          বাবামায়ের শোবার ঘরে ঢুকে লাইটের সুইচটা অন করে জিজ্ঞেস করে -- মা কি হল?

এইভাবে অন্ধকারে বসে আছ দুজনে ? কোন প্রবলেম ?

          নিবেদিতা একটা বড় শ্বাস ফেলে উত্তর দেয় -- কি হবে আবার ?এমনিই বসে আছি।

          দিবাকর জিজ্ঞেস করে -- বাবার ব্লাড রিপোর্ট গুলি এসেছে ?

          নিবেদিতা বলে -- হ‍্যাঁ এসেছে। ঐ তো  বিছানার তলায় আছে।

          নিবেদিতা জানত যে কমলেশ এইচ ওয়াই ভির রিপোর্টটা সরিয়ে রেখেছে। কিন্তু না, মনের অস্থিরতায় ব‍্যাপারটি একেবারেই ভুলে গিয়েছে কমলেশ। দিবাকর একের পর এক রিপোর্টগুলি দেখতে থাকে এবং স্বস্তিসূচক ভঙ্গিতে নিজের মনেই বলতে থাকে -- টি.সি.ডি.সি, ই.এস.আর তো ঠিকই আছে, ফাস্টিং - বি.পি ও কন্ট্রোলেই আছে, কোলেস্টরল, ইউরিক অ‍্যাসিড, থাইরয়েড পজিসনও..........

          তারপরে হঠাৎই বাকরুদ্ধ হয়ে যায় দিবাকর। ওর সামনে সারা ঘরটা দুলতে থাকে। বিড় বিড় করতে থাকে -- এটা কি করে সম্ভব ? এইচ.ওয়াই ভি পজিটিভ ! মানেটা কি? নির্ঘাত ভুল করেছে কোথাও প‍্যাথেলজি সেন্টার। না না কালকে আবার অন‍্য কোন ভাল জায়গা থেকে করাতে হবে। এ হতে পারে না।

         স্নিগ্ধা মুখটা ব‍্যাজার করে শ্বশুরের দিকে একবার সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকিয়ে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে। ওর গমন পথের দিকে অবাক বিষ্ময়ে চেয়ে থাকে নিবেদিতা। কমলেশের নির্বাক ভাবলেশহীন চোখ দিয়ে দু ফোঁটা জল ঝরে পড়ে। দিবাকর স্বগতোক্তির মত বলে -- দেখি রয় ত্রিবেদীতে একবার ফোন করে। কালই ব্লাডটা নিয়ে যাক্!

          বাবা বা মা কারো সাথেই কোন কথা না বলে রিপোর্টের খামটা আবার বিছানার তলায় চাপা দিয়ে ধীরপদে বেরিয়ে আসে বাবামায়ের বেডরুম থেকে। ওদের বেডরুমের দরজাটা দড়াম করে বন্ধ হয়।

                       পরের দিন সকালে রয় এন্ড ত্রিবেদীর পাঠানো লোক এসে কমলেশের ব্লাড নিয়ে যায়। একটা ট্রলিব‍্যাগ নিয়ে স্নিগ্ধা কলেজ যাবার সময় শাশুড়িকে বলে যায় যে ও কয়েকটা দিন বাপের বাড়ি থাকবে এবং ওখান থেকেই কলেজে যাতায়ত করবে। শ্বশুরের আপডেট তো প্রতিদিনই পেয়ে যাবে দিবাকরের কাছে। খুব প্রয়োজন হলে এই বাড়িতে চলে আসবে।

           কমলেশ বুঝতে পারছে কয়েক ঘন্টার ব‍্যবধানেই ওর দুনিয়াটা বদলে যেতে শুরু করেছে। নিবেদিতাও লক্ষ‍্য করেছে ব‍্যাপারটা। বৌমাকে মনে হল ও যেন পালাতে চাইছে! ছেলেও খুব গম্ভীরমুখেই বেরিয়ে গেল কলেজের পথে। কমলেশের বয়সও এক রাতের মধ‍্যেই দশ বছর বেড়ে গেছে। রক্ত নিয়ে যাবার পর ঝুল বারান্দার চেয়ারটাতে বসে চা খেল দুটো থিন অ‍্যারারুট দিয়ে। ব্রেক ফাষ্টে আর কিছুই খেতে চাইল না। অত ছটফটে হুল্লোরে মানুষটা সকালে চায়ের ঠেকেও গেল না। চেয়ারে চুপটি করে বসে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে নিষ্পলক দৃষ্টিতে। একটা দীর্ঘ শ্বাস বেরিয়ে এল নিবেদিতার বুকটা চিরে।

         রাত সাড়ে নটায় দিবাকর একাই বাড়ি ফেরে। কথা অনুযায়ী স্নিগ্ধার ফেরার কথাও নয়। এসে নিবেদিতাকে জানায় যে ও রাতে খাবে না। ফেরার পথে স্নিগ্ধাকে ওদের বাড়িতে ড্রপ করতে গিয়েছিল এবং ডিনার ওখানেই সেরে এসেছে।

          নিবেদিতার মেজাজটা উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। কঠিন স্বরেই বলে -- সে তো ভাল কথা। তা সেটা সন্ধ‍্যেবেলাতেই জানাস নি কেন? তাহলে তো আর কষ্ট করে রুটি ভাজতে হ'তো না। দুপুরের যা ভাত ছিল তা ওভেনে গরম করে নিলেই তো তোর বাবার আর আমার দিব‍্যি হয়ে যেত। আর ঐ বাড়িতে যে যাবি সেটা তো বলে যাবি। খামোকা অসুস্থ মানুষটাকে এত চিন্তা করাস কেন ?

         দিবাকরেরও মেজাজটা খিজরে আছে ; শ্বশুরবাড়িতে স্নিগ্ধা বা ওর বাপমায়ের সাথে বাবার অসুখের ব‍্যাপারে সবিস্তারে আলোচনা হয়েছে। স্নিগ্ধা পরিস্কার জানিয়ে দিয়েছে যে শ্বশুরমশাইকে নার্সিংহোমে না অ‍্যাডমিট করা পর্যন্ত ও কিছুতেই বাড়িতে ফিরবে না। দিবাকরের শাশুড়ীও সমর্থন করেন মেয়েকে। হাজার হোক মারাত্মক ছোঁয়াচে রোগ। যদিও  স্নিগ্ধার বাবা মেয়েকে বোঝাতে চেয়েছিলেন যে রোগটি আদৌ সাধারণভাবে ছোঁয়াচে নয়। কিন্তু তাতে আমল দেবার পাত্রী মা মেয়ে কেউই নয়। শাশুড়ী উল্টে দিবাকরকে সৎ পরামর্শ দেন যে দিবাকরও তাদের বাড়িতেই থাকুক না হয় ক'টা দিন! দিবাকর কিংকর্তব‍্যবিমূঢ় হয়ে গেছে। ও ভাবতেই পারছে না যে ওর বাবা এইরকম একটি জঘন‍্য রোগ নিজের শরীরে আনলেন কোথা থেকে ! তবে কী..........? মায়ের মুখের উপর ঝাঁঝিয়ে উত্তর দিল -- অত চিন্তা করার কি আছে তোমাদের ? ওকে তো কলেজ ফেরতা পথে বাড়িতে ড্রপ করতেই হবে আমায় । এটা তো বোঝা উচিত তোমার। আর দেরী যখন হচ্ছে তখন তো বুঝতে পারা উচিত যে রাতে খেয়েই আসব আমি !

          স্নিগ্ধা চেঁচিয়ে ওঠে -- হ‍্যাঁ সবই তো আমায় বুঝে নিতে হবে। তোমার তো কোন বোঝাবুঝির দায় নেই। বাবার ব্লাড নিয়ে গেল, রিপোর্ট এল কী না কিংবা কি রিপোর্ট এল -- কোন চিন্তা করার দায় আছে না কী তোমার ?

          মায়ের এই মূর্ত্তির সাথে ছেলেবেলা থেকেই দিবাকর সুপরিচিত। মা খুব রেগে গেলেই ওকে তুমি বলে সম্বোধন করে। নিজেকে সংযত করে নেয়। ঠান্ডা গলায় বলে -- আরে বাবা রিপোর্ট তো কাল দুপুরে দেবে। সেটা তো আমি জানিই। আর তাছাড়া রিপোর্ট তো একই আসবে। ঐসব রিপোর্ট সচরাচর ভুল হয় না।

          নিবেদিতা অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে ছেলের মুখ পানে। কাল রাতেই যে ছেলে বলল এই রিপোর্ট ভুলভাল, যার জন‍্য আজ আবার ফের ব্লাডটেষ্টের ব‍্যবস্থা করা হল। এক বেলা শেষেই ছেলের ধ‍্যানধারণা আমুল বদলে গেল ! নিবেদিতা বুঝতেই পারলেন যে শ্বশুর বাড়িতে বিষয়টি নিয়ে বিশদ আলোচনাই হয়েছে। ছেলেকে বললেন -- কাল রাত্রেই তো তুই বললি যে রিপোর্টটা ভুল। এখন বলছিস্ যে ওটা সঠিক রিপোর্টই। তাহলে আজ আবার রক্তপরীক্ষা করতে দিলি কেন ?

         দিবাকর বলে -- আরে বাবা সেটা তো কনফার্ম হবার জন‍্যই আবার টেষ্ট করানো। আমি কয়েকজনের সাথে আলোচনা করলাম। সবাই একটা কথাই বলল যে -- এইসব রিপোর্ট  চট্ করে খুব একটা ভুল হয় না। আমি ভাবছি অন‍্য কথা।

         নিবেদিতা অসহায় সুরে জিজ্ঞেস করে --

কি অন‍্য কথা ?

         দিবাকর কুন্ঠা সহকারে উত্তর দেয় -- আমি ভাবছি বাবার শরীরে এই জঘন‍্য রোগটা এল কি করে? একমাত্র সেক্চুয়াল কানেকশনেই এটা সম্ভব। তবে কী বাবা ------?

         ছেলের কথার ইঙ্গিতটা খুব ভাল মতই বুঝতে পারছে নিবেদিতা। ছেলের উপর রাগে ঘেন্নায় গা টা রি রি করে ওঠে। খুব ঠান্ডা গলায় বলে -- তার মানে তুমি কি বলতে চাইছ? তুমি কিন্তু তোমার বাবার চরিত্র সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করছ দিবা !

        দিবাকর বলে -- মা রাগ ক'রো না। বি প্র‍্যাক্টিক‍্যাল। বাবা সারা জীবনই বাইরে বাইরে কাটিয়েছে চাকরির জন‍্য। প্রত‍্যেকের জীবনেই একটা বায়োলজিক‍্যাল নীড থাকে। এটা হতেই পারে যে অন‍্য কোন সংসর্গে..........

         আর নিজেকে সংযত রাখতে পারে না নিবেদিতা। ঠাস করে একটা চড় কষিয়ে দেয় ছেলের গালে। অস্বাভাবিক স্বরে চিৎকার করে ওঠে -- জাষ্ট স্টপ ইট। আমার চোখের সামনে থেকে দূর হয়ে যা। অনেক বড় হয়ে গেছ তুমি। বাবার সম্পর্কে যা খুশী তাই বলে যাচ্ছ। তোমরা না প্রফেসারি কর! বিশাল শিক্ষিত ! আমার বিদ‍্যা তো বি.এ পার্ট ওয়ান। আমি জানি যে রক্ত নেবার মাধ‍্যমে এমন ইনজেকশনের নীডল থেকেও এই রোগটা শরীরে ঢুকতে পারে ; তোমরা ডক্টরেটরা জান না সেটা ?

         নিবেদিতার অস্বাভাবিক চিৎকারে নিজেদের বেডরুম থেকে কিচেনে ছুটে আসে কমলেশ। কমলেশকে দেখে আরও উত্তেজিত হয়ে পড়ে নিবেদিতা -- খুব না ছেলে ছেলে করে মরতে? ছেলের একটু জ্বর হলেই রাত জেগে ঘুমন্ত ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে, বার বার টেম্পেরেচার দেখে, কপালে জলপট্টি দিয়ে রাত কাটাতে ? ঘরের গোপালের জন‍্য ঘরভর্ত্তি লোকের সামনে আমায় চড় মেরেছিলে, পিতলের গোপাল আসন থেকে তুলে নিয়ে কুঁয়োয় ফেলেছিলে ? বেশ হয়েছে। খুব ভাল প্রতিদান পাচ্ছ।

         রাগে থর থর করে কাঁপছে নিবেদিতা। কমলেশ তাকে জড়িয়ে ধরে ডাইনিং টেবিলের চেয়ারে বসিয়ে দেয়। মাথায় হাত বুলিয়ে বলে -- নিবু, কি  হচ্ছে এসব? তুমি কী স্ট্রোক করে মরবে না কী? একটু শান্ত হও, মাথাটা ঠান্ডা কর প্লীজ। এইরকম করলে তো মারা পড়বে তুমি।

         নিবেদিতা ঠান্ডা হয় না। কিন্তু আর চেঁচানোর শক্তি নেই তার। স্বামীকে দু হাতে আঁকড়ে ধরে হাউ হাউ করে কেঁদে ওঠে -- এই কথা শোনার চাইতে আমার মরে যাওয়াই ভাল ছিল।

         দিবাকর মায়ের অবস্থা দেখে ভয় পেয়ে যায়। মাকে ছুঁয়ে বলতে যায় -- ও মা, আমি ভুল করেছি, আমি সরি! এরকম ক'রো না মা।

       আবার রাগে ফেটে পড়ে নিবেদিতা -- একদম টাচ করবি না আমায়। খবরদার আমায় আর মা বলে ডাকবি না। আমার কোন সন্তান নেই। আমি কারো মা নই। আমি ভেবে নেব আমার ছেলে মরে গেছে।

       -- নিবেদিতা! বাঘের গর্জন ধ্বনিত হয় কমলেশের কন্ঠে। ডানহাতটা সপাটে নেমে আসে নিবেদিতার গালে। অস্থিরভাবে বলতে থাকে কমলেশ -- এটা কি বললে? কি বললে তুমি ?

         নিবেদিতা গালে হাত দিয়ে কঁকিয়ে ওঠে -- হায় রে অন্ধপিতা ধৃতরাষ্ট্র। আজ এত বছর পরে একটা কুলাঙ্গারের জন‍্য আবার আমার গায়ে হাত তুললে। লোকে বলে মায়ের আদরে সন্তান বাদর হয়। মিছে কথা -- ডাহা মিথ‍্যে কথা। তোমার মত বাবা থাকলে মাকে কি প্রয়োজন ছেলেকে নষ্ট করার, কুলাঙ্গার বানানোর ? তুমি বুড়ো সত‍্যিই ধৃতরাষ্ট্র!

        আস্তে আস্তে উঠে নিজেদের শোবার ঘরে চলে যায় নিবেদিতা। দিবাকর পরিস্থিতির চমকে হতবাক হয়ে বসে পড়ে একটা চেয়ারে। দু হাত কপাল চেপে অধোবদনে বসে থাকে। কমলেশ ওর মাথায় হাতটা বুলিয়ে বলে -- যা তুই জামাকাপড় বদলে ফ্রেস হয়ে নে। চিন্তা করিস না ; তোর মায়ের প্রেসারটা মনে হয় বেড়েছে। রাতে ঘুমোলেই ঠিক হয়ে যাবে।

         বলে নিজের ঘরে ঢুকে যায় কমলেশ। ফ্রীজ থেকে জলের বোতল নিয়ে নিজের ঘরে ঢোকে দিবাকর।

                            ঘরে ঢুকে কমলেশ দেখে নিবেদিতা ঘরে নেই। ঝুল বারান্দায় গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে আছে সে আকাশের দিকে তাকিয়ে। কমলেশ গুটি গুটি পায়ে পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। বুঝতে পারে নিবেদিতা ফুঁপিয়ে চলেছে। এটাও জানে কমলেশ যে চড় খাবার রাগে বা স্বামীর উপর অভিমানে নয়, দিবাকর এমন কিছু বলেছে বা ব‍্যবহার করেছে সেই দুঃখে কাঁদছে নিবু। পরম আদরে নিবেদিতার শাড়ির আঁচল দিয়েই চোখ মুছিয়ে দিয়ে নিবেদিতার মাথাটাকে বুকে টেনে নেয় কমলেশ। নিবেদিতাও ডুকরে কেঁদে মুখ লুকায় কমলেশের বুকে।

        কমলেশ ওর পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে বলে -- এই দেখ, আবার কাঁদে! সাড়ে দশটা বেজে গেছে। খেতে দেবে না ?

          -- ও মা, সে কী গো? চল চল খেতে চল। আজ তো তোমার খেতে অনেক রাত হয়ে গেল গো! বলে প্রায় ছুটেই ডাইনিং টেবিলে এসে দুটো ডিসে রুটি সবজী আঁচার আর ছোলার ডাল গোছাতে শুরু করে নিবেদিতা। চেয়ার টেনে বসে কমলেশ। দুটো ডিস দেখে অবাক হয়ে শুধায় -- দুটো ডিস কেন?

          নিবেদিতা উত্তর দেয় -- দিবা ও বাড়ি থেকে খেয়ে এসেছে।

          কমলেশের মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি খেলে -- তাহলে এক কাজ কর, একটা ডিসেই নাও। আমি আজ আর হাত লাগাব না। তুমি নিজেও খাবে আর আমাকেও খাইয়ে দেবে।

          কমলেশের পাগলামিতে ক্ষেপে যায় নিবেদিতা। আবার মনের গোপন কোণে খুশীর বানও ডাকে। চোখ পাকিয়ে বলে --  ঢং! বুড়ো বয়সে আদিখ‍্যেতা।

          মুখে বলল বটে, কিন্তু স্বামীর কথা মত একটা ডিসেই খাবার বাড়ল। কমলেশকে খাইয়ে পরে সে নিজেও খেয়ে নেবে। কিন্তু বুড়োর বাতিক শুরু হল -- উহুঁ ওটি হবে না। আমি একটুকরো তুমি এক টুকরো।

         অগত‍্যা তাই করতে হল নিবেদিতাকে। খেতে খেতে চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে আসে নিবেদিতার। ও ভাবতেই পারছে না শিশুর মত এত প্রাণোচ্ছল একটা মানুষের এ কী মারণ ব‍্যাধি হল। বাইপাশের সময়ও নিবেদিতার মনটা এরকম কু ডাকে নি। ছেলেটাও ছিল একদম বাপের মত। ইউনিভার্সিটিতে পড়া অবধি ওকে দুবেলা ভাত মেখে খাইয়ে দিতে হয়েছে । বিয়ের পরও নূতন বৌয়ের সামনেই একদিন আবদার করে বসল -- ও মা, তুমি আজ আমায় খাইয়ে দাও না। খুব ঠান্ডা আজ। আমি হাত দিয়ে খাব না, হাতও ধুতে পারব না। নিবেদিতাও মহানন্দে ছেলেকে ভাত মেখে খাওয়াতে শুরু করে দিল। তাই দেখে স্নিগ্ধার সে কী হাসি! হাসতে হাসতে টিপ্পনী কাটে  -- ধেড়ে খোকার সখ হয়েছে মায়ের হাতে খাবার। ভাত নয় মা কষিয়ে দুটো চড় খাওয়ান পাজী ছেলেটাকে।

          কমলেশ বলেছিল -- বুঝলি রে মা, আমার তো আর মা নেই ; কে খাইয়ে দেবে আর?

          স্নিগ্ধা হেসে বলেছিল -- আপনার মা নেই মানে! আমি তবে কে ? তবে আরো বছর পনের পরে আপনি যখন অনেক ছোট ছেলে হয়ে যাবেন তখন আমি আপনাকে রোজ খাইয়ে দেব। আই প্রমিজ। তবে মায়ের মত ধেড়ে খোকাকে খাওয়াব না।

           এই তো সেদিন মাত্র ; বছর খানেকও হয় নি। আর আজ শ্বশুরের মারণব‍্যাধি জেনে পালিয়ে চলে গেল বাপের বাড়িতে। আর পরের মেয়ের কথা ভেবে কি লাভ ? নিজের ঔরসজাত সন্তান -- সে কত সহজেই বাপের চরিত্র নিয়ে সন্দিহান হয়ে পড়ল ! হায় রে দুনিয়া! চোখের পাতা ভারী হয়ে ওঠে নিবেদিতার।

           কমলেশ লক্ষ‍্য করে নিবেদিতাকে। একটা কপট ধমক লাগায় -- কি হল কী নিবু ? আবার কাঁদছ কেন ?

         নিবেদিতা উত্তর দেয় -- ও কিছু না। এমনিই......

         কমলেশ বলে -- এমনি এমনি কেউ কাঁদে ? ঠিক আছে তোমার চোখের জল আমি সব শুষে নেব। বলেই নিবেদিতার চোখের কোলে টলটল করা এক বিন্দু অশ্রু হঠাৎই ডানহাতের তর্জনীর ডগায় তুলে নিয়ে চালান করে দেয় নিজের জিভে।

      লজ্জা এবং এক অদ্ভুত ভাল লাগায় শিউরে ওঠে নিবেদিতা। একটুকরো সলজ্জ হাসি ঠোঁটে নিয়ে বলে -- এটা কি হল ?

         কমলেশ কপট গাম্ভীর্য নিয়ে বলে -- বারে খালি শুকনো রুটি গিলিয়ে যাচ্ছ। আমার বুঝি পিপাসা লাগে না ? তাই তো জল খেলাম। খুব মিষ্টি জানো তো জলটা !

Comments

Popular posts from this blog

A New Beginning

Internship for Microbiology?

10 Best Microbiology Research Projects for College Students