নিবেদিতার সংসার

নিবেদিতার সংসার 
 
 

 
 
 (প্রথম পর্ব)
 
--- প্রশান্ত পাইন
 
 
 
    দুপুর দুটো নাগাদ ব্লাড টেষ্টের রিপোর্টটা হাতে এসেছে কমলেশের। তার পর থেকেই কেমন যেন উদভ্রান্ত লাগছে মানুষটাকে। প্রায় চল্লিশ বছর হতে চলল মানুষটাকে দেখছে নিবেদিতা, মানে কমলেশের চল্লিশ বছরের জীবনসঙ্গিনী, তার একমাত্র সন্তান দিবাকরের জন্মদাত্রী। কোন রোগবালাই ওকে নিজেকে জব্দ করা তো দূর অস্ত, পরিবারের কারো কোন মারাত্মক অসুখে বিসুখে কমলেশকে কখনও দেখে নি নিবেদিতা উদ্বিগ্ন হতে বা হতাশ হতে কিংবা মাথা গরম করতে। খুব ঠান্ডা মাথায় একাগ্র চিত্তে যে কোন মারাত্মক অবস্থাকে সামলে নিত অনায়াস ভঙ্গিতে। ঐরকম পরিস্থিতিকে কমলেশের চোখমুখের ভাবের একটা পরিবর্তনই লক্ষ্য করত নিবেদিতা ; খুব বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে ওর চোখদুটো খুব কঠিন এবং দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে উঠত। ওর চোখ দুটো তখন যেন ভগবানের দিকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে বলত -- আমি রইলাম এখানে ; দেখি কিভাবে তুমি তুলে নাও ! নিজের হার্টের বাইপাস সার্জারির সময় অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাবার সময়েও উদ্বিগ্ন ভাইদের দিকে হেসে তাকিয়ে,ছেলের মাথায় হাতটা বুলিয়ে এবং নিবেদিতার হাতে সজোরে চাপ দিয়ে যেন এটাই বলতে চেয়েছিল -- ডোন্ট ওরি, আই উইল সারটেইনলি কাম ব্যাক! সুদীর্ঘ চল্লিশ বছরের সাংসারিক ক্ষেত্রে একবারই মানুষটাকে চরম উত্তেজিত হতে দেখেছ নিবেদিতা ; সেটা ছেলে দিবাকরের ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়ার সময়। দিবাকর তখন সম্ভবত ক্লাস সিক্সে পড়ে। সেদিন নিবেদিতা তার মায়ের পরামর্শে বাড়িতে গোপাল প্রতিষ্ঠার আয়োজনে ব্যস্ত। এলাহি গোপাল ভোগের আয়োজন। দিবাকর সারা দিন ভর খাটে শুয়ে সব আয়োজন দেখে যাচ্ছিল একাগ্র মনে। বিকেল চারটে নাগাদ হঠাৎই কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ে গুটিশুটি মেরে খাটের এক কোণে। পিতলের গোপালের যত্ন আত্তির আতিশয্যে নিবেদিতা বা তার মা এবং দুই জা কেউ একবারও খোঁজ নিতে পারে নি বাড়ির বাল গোপালের শারীরিক অসুবিধার ব্যাপারে। কমলেশ সেদিন নিবেদিতার অনুরোধ মত অফিস থেকে সাড়ে পাঁচটার মধ্যেই বাড়ি ফেরে। ছেলেকে ঐ সময়ে ঐভাবে শুয়ে থাকতে দেখে অবাকই হয়। অফিসের জামাকাপড় ছেড়ে ছেলেকে জিজ্ঞেস করে -- কি রে দেবা, এই অবেলায় শুয়ে আছিস কেন? কি হয়েছে রে? মা বকেছে না কী ?
দিবাকর কোন উত্তর দেয় না। অস্ফুট স্বরে গোঙাতে থাকে। কমলেশ খাটে বসতেই অনুভব করে যে খাটটা আশ্চর্যজনক ভাবে কাঁপছে। কি এক অজানা আশঙ্কায় ছেলের গায়ে হাত রেখে চমকে ওঠে কমলেশ। ছেলের গা ফার্নেসের মত গরম, হি হি করে কাঁপছে ছেলে। অস্ফুট স্বরে বলে -- খুব শীত করছে বাবা, আমাকে একটু চেপে ধর। ছেলেবেলা থেকে মা এবং ভাইদের নানান ধরণের অসুখের সামনাসামনি হওয়া কমলেশের বুঝতে কোন অসুবিধা হয় নি যে ছেলের এই জ্বরটা স্বাভাবিক নয়। থার্মোমিটারে পারদ ১০৪ ° ফারেনহাইট পেরিয়ে গেছে। স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করে -- ওর জ্বর কখন এসেছে?
নিবেদিতা বলে -- আমি কি করে জানব? সকাল থেকেই তো খাটে বসে পূজোর কাজ দেখছিল। হঠাৎ কখন কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়েছে তা তো খেয়াল করি নি।
কমলেশের মাথায় আগুন ধরে যায় । শাশুড়ি, ঠাকুরমশাই, নিবেদিতা ও দুই ভ্রাতৃবধূকে হতবাক করে আসন থেকে গোপালের মূর্ত্তিটাকে তুলে নিয়ে ছিটকে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে। উঠোনে পাতকূয়ায় ছুড়ে ফেলে দিয়ে গজগজ করতে করতে ঘরে ঢোকে -- শালার গোপালভোগ হচ্ছে ! ছেলে মরছে জ্বরে! গোপালের গুষ্টির ক্যাথায় আগুন।
কমলেশের রুদ্রমূর্ত্তিতে চুপসে যায় নিবেদিতা। ছোটভাইকে ডেকে ছেলেকে শালে জড়িয়ে কমলেশ ছুটে বেরিয়ে যায় নার্সিং হোমের দিকে। সঙ্গে সঙ্গে রক্তপরীক্ষা করে জানা গেল ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়া। ডাক্তার দেখে বললেন যে ঘাড় শক্ত হয়ে উঠছে। তখনই অ্যাডমিট করা হল। স্পেশ্যাল কেবিনে নিবেদিতারও থাকার ব্যবস্থা করা হল। কমলেশ আর ওর ছোটভাই দুজনেই রাতে থেকে গেল নার্সিংহোমের রিসেপশন কাউন্টারে। ঐ একবারই কমলেশকে পাগলের মত দেখেছিল নিবেদিতা। সেই মানুষটাই আজ হঠাৎ এইরকম অস্থির হয়ে উঠল কেন ? কি এমন আছে ব্লাড রিপোর্টে ? কমলেশ আগে চেইন স্মোকার ছিল ; বাইপাশ হবার পর বিগত পাঁচ ছয় বছর ধরে ডাক্তারের অনুমতি সাপেক্ষে সারা দিনে একটি মাত্র সিগারেটে দু তিন টান মেরে ফেলে দিত দুপুরে খাবার পর। সেই লোক কি না একটার পর একটা সিগারেট খেয়ে যাচ্ছে আর ঝুল বারান্দায় পায়চারী করছে অস্থিরভাবে। নিবেদিতা কিছু জিজ্ঞেস করতে ভয় পাচ্ছে। বিছানার নীচ থেকে ব্লাড রিপোর্টের এনভেলাপটা খুলে রিপোর্টে চোখ বোলাল নিবেদিতা। ওর পায়ের তলার মাটিটা সরে যাচ্ছে ক্রমশ, মাঘমাসেও দর দর করে ঘামছে সে, চোখে অন্ধকার নেমে আসে। বিছানায় ধপ্ করে বসে পড়ে নিবেদিতা। প্রাণপণে চেষ্টা করে নিজেকে সামলাতে। এরই মধ্যে কখন যে ওর সামনে এসে দাঁড়িয়েছে কমলেশ বুঝতে পারে নি নিবেদিতা। কাঁধে হাতের স্পর্শে সম্বিত ফেরে নিবেদিতার। মুখ উঁচু করে তাকায় স্বামীর মুখের পানে। কমলেশের দু চোখে তখন জলের ধারা। নিবেদিতার মুখটা আছড়ে পড়ে কমলেশের সেলাই করা বুকে। ওর হাতের মুঠোয় গুটিয়ে থাকা ব্লাড রিপোর্টে তখন জ্বল জ্বল করছে " HYV - Positive ". কমলেশকে জড়িয়ে ধরে পাগলের মত চীৎকার করতে থাকে নিবেদিতা -- মিথ্যে মিথ্যে রিপোর্ট -- মিথ্যে রিপোর্ট। 
 
 
( ক্রমশঃ)

 

Comments

Popular posts from this blog

A New Beginning

Internship for Microbiology?

10 Best Microbiology Research Projects for College Students